মধ্যবিত্ত কি অভিশাপ নাকি আর্শীবাদ?

1586601490_images-1.jpg
কেউ কি মধ্যবিত্তের কথা ভাবছেন!

‘মধ্যবিত্ত’ নামে একটি শব্দ আছে। না ওপরে। আবার নিচেও না। মাঝামাঝি এদের অবস্থান। এ জন্য নামটি ‘মধ্যবিত্ত’। এই মধ্যবিত্তেরও আবার একটি ভাগ আছে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত। দুই ভাই অথবা দুই বোন, অথবা এক ভাই, এক বোন। একজন মধ্যবিত্ত। অন্যজন নিম্নমধ্যবিত্ত। দুই স্তরের মানুষই বড় অসহায়। তারা মুখ ফুটে পারে না কিছু বলতে। চরম দুর্দিনেও তারা মুখ খুলতে নারাজ। বলতে নারাজ আমি বা আমরা ভালো নেই। নিদারুণ কষ্টে আছি। বরং নিজেকে, নিজেদের লুকিয়ে রাখার প্রবণতাটাই বেশি। পাছে না অন্যে জেনে যায়। কী লজ্জার হবে সেটা!

করোনাকালের এই দুঃসময়ে চরম দুর্দিনে পড়েছে মধ্যবিত্ত পরিবার। সীমিত আয়ে যাদের জীবন যাপন করতে হয়। ছোট চাকরি, ছোট ব্যবসা। কিন্তু স্বপ্ন অনেক বড়। ছোট বাসায় থাকে অনেকে। মাস শেষে বাড়িভাড়া, বাজার খরচ, সন্তানদের স্কুলের বেতন, আনুষঙ্গিক আরো অনেক খাতে খরচ করতে হয়। কোনো কারণে পাঁচ-সাত দিন আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হলেই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে নেমে আসে অশান্তি। সেখানে অনির্দিষ্টকাল ধরে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়-রোজগার বন্ধ। সরকারি চাকরিজীবী মধ্যবিত্তরা হয়তো একটু নিরাপদ আছে। কিন্তু তারা তো সংখ্যায় কম। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার পড়েছে অথই সাগরে। একে তো করোনার ভয়, উপরন্তু আর্থিক অনিশ্চয়তা। আয়-রোজগার বন্ধ। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে অস্থির করে তুলেছে।
কয়েক দিন আগে পেপারে এক ঘটনা চোখে পড়ল । ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় দুস্থ পরিবারের মধ্যে চাল, ডাল, লবণ, পেঁয়াজ, মরিচের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল। রিকশাওয়ালা ও পথের ছিন্নমূল মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ একজনকে লাইন থেকে বের করে দিল স্বেচ্ছাসেবকরা। তার অপরাধ কী? খোঁজ নিয়ে জানা গেল ওই লোকের বেশভূষা দেখে অসহায় অথবা দুস্থ মনে হচ্ছে না। লোকটি বারবার বোঝাচ্ছিল ‘ভাই, আমি সত্যি সত্যি আর্থিক সংকটে পড়েছি। ছোট ব্যবসা করি। ব্যবসা বন্ধ। আমার পরিবার দুই দিন ধরে না খেয়ে আছে। প্লিজ, আমাকে একটু সাহায্য করেন।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে পাত্তাই দিল না। লাইন থেকে বের করে দিল। চোখের পানি ফেলে চলে যাচ্ছিল লোকটি। পরিস্থিতি দেখে উদ্যোক্তাদেরই একজন এগিয়ে এসে লোকটির হাতে ত্রাণের একটি ব্যাগ তুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডুকরে কেঁদে ফেলল লোকটি। বলল, ‘ভাই, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আজ আমার পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত উঠবে। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুক।’
আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আলি।
রাস্তার পাশে ফুটপাতে ত্রাণ বিতরণ করছিল একটি সংগঠন। দুস্থ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বয়স্ক মানুষকে দেখলাম অসহায় চোখে মানুষের দীর্ঘ লাইনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—কী দেখছেন?

একটু যেন লজ্জা পেলেন আমার কথা শুনে। তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা আমি যদি লাইনে দাঁড়াই ওরা কি আমাকে ত্রাণ সহায়তা দিবে?’
লোকটির পরনে ভদ্র পোশাক। আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারও ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন? দেখে তো মনে হচ্ছে না।

চোখে-মুখে সীমাহীন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘আমার এই লেবাসটা অনেক যন্ত্রণার হয়ে উঠেছে। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছি না যে আমি, আমার পরিবার দারুণ আর্থিক কষ্টে আছি। লেবাস বদলে যে পথে নামব, তা-ও তো সম্ভব না! উচ্চবিত্তের দারুণ আনন্দ। কেউ কেউ হাত খুলে সাহায্য দিচ্ছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ কোনো সংকোচ ছাড়াই সেই সাহায্য গ্রহণ করছে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষেরা পড়েছি চরম বিপাকে। না পারছি হাত পাততে, না পারছি কাউকে কিছু বোঝাতে।’

সামনে ঈদ আসন্ন। তখনকার পরিস্থিতি কী হবে সেটা ভেবে আরো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে। সরকার নানা স্তরের মানুষের জন্য আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে অসহায় মধ্যবিত্তের জন্য কোনো আর্থিক প্রণোদনার কথা নেই। ফলে চরম হতাশার সাগরে পড়েছে দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ।

প্রয়াত লেখক, চলচ্চিত্রকার সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘মধ্যবিত্ত হয়ে জন্মানোর চেয়ে ফকির হয়ে জন্মানো ভালো। ফকিরদের অভিনয় করতে হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্তদের প্রতিনিয়ত সুখী থাকার অভিনয় করতে হয়।’

কিন্তু করোনার এই দুঃসময়ে সুখী থাকার অভিনয় করাটা অনেক দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্তের জন্য। মধ্যবিত্তের কষ্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন লিখেছেন, ‘নীরবে ভিজে যায় চোখের পাতা। কষ্টের আঘাতে বেড়ে যায় বুকের ব্যথা, জানি না এভাবে কাটাতে হবে কত দিন? আমার এই জীবনে কি আসবে না সুখের দিন?’ সুখ তো পরের কথা। এখন প্রয়োজন করোনা থেকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে পারস্পরিক সহযোগিতা। সেখানে ‘মধ্যবিত্তরা’ সমাজের একটি অংশ। চলমান সংকটে তাদের জন্যও একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি।

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
2 Comments
Ecency